বিশেষ সংবাদদাতা : চিনা সংসদের অধিবেশন শুরুর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে চিনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোভিড প্যানডেমিক নিয়ে চিনের বিরুদ্ধে 'মিথ্যা ভিত্তিহীন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' ছড়িয়ে দুই দেশের মধ্যে নতুন এক শীতল যুদ্ধ শুরুর চেষ্টা করছে। চিনা মন্ত্রী বলেন, গত কয়েক দশক ধরে দুই দেশের সহযোগিতার ফলে যে সুফল তৈরি হয়েছে, তা নষ্ট করলে তাতে আমেরিকার নিজের ক্ষতি তো হবেই, পুরো বিশ্বের স্থিতিশীলতা এবং সচ্ছলতা সংকটের মুখে পড়বে।
চিনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই |
অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের মতে, বেশ আগে থেকেই বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনীতির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বৈরিতা দিনে দিনে বাড়ছে। করোনাভাইরাস প্যানডেমিক তাতে শুধু নতুন একটি মাত্রা যোগ করেছে। বেইজিং ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর চায়না অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশনের প্রেসিডেন্ট ওয়াং হুহাইওর মতে, ১৯৭৯ সালে দুই দেশের মধ্যে পুরোমাত্রায় কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর পারস্পরিক অবিশ্বাস এত খারাপ কখনো যায় নি।
এশিয়া সোসাইটির মার্কিন-চীন সেন্টারের পরিচালক অরভিল শেল বলেন, 'আমরা এখন একটি শীতল যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে।' হংকংয়ের ব্যাপটিস্ট ইউনিভার্সিটির রাজনীতির অধ্যাপক জ্যঁ পিয়ের সেবাস্টিয়ান লন্ডনের ফিনানশিয়াল টাইমস পত্রিকাকে বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন নতুন এক ধরণের শীতল যুদ্ধের মুখামুখি হয়েছে।
মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক ড সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন , সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের যে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল নেয়, তাতে পরিষ্কার বলা আছে, আর কোনদিনই বিশ্বের কোথাও তারা এমন কোন শক্তিকে মাথাচাড়া দিতে দেবে না যারা আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। অনেকদিন ধরেই চীনকে তারা ভবিষ্যতে সেই ধরণের একটি চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিষয়ক সরকারি সমস্ত নথিপত্র ও দলিলে তা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।
চিনের চিন্তার কারণ :
ড. আলী বলেন চিনের প্রতি বৈরিতা আমেরিকা শুধু নথিপত্রের ভেতর সীমাবদ্ধ না রেখে বেশ কিছুদিন ধরেই কার্যকরী করতে শুরু করেছে। চিনের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের সাথে, যেমন ভারত, জাপান, ভিয়েতনাম, সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশগুলোর সাথে যৌথ সামরিক মহড়াও করছে। রয়টার্স বলছে, চিনের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি অভ্যন্তরীণ নথিতে দেশের শীর্ষ নেতৃত্বকে সতর্ক করা হয়েছে যে চিনের প্রতি যে বৈরি মনোভাব বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে এখন তৈরি হয়েছে, তার নজির ১৯৮৯তে তিয়েনানমেন স্কয়ারের ঘটনার পর দেখা যায়নি।
তাহলে কি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্র এবং চিনের মধ্যে শীতল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে? এই প্রশ্নে ড মাহমুদ আলী বলেন, যে শীতল যুদ্ধ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলেছে, তেমনটি শুরু হয়েছে বা অদূর ভবিষ্যতে হবে বলে তিনি মনে করেন না। তার মতে, সে ধরণের তথাকথিত শীতল যুদ্ধ শুরু করলেও, চীন এখনো কিছুই করেনি বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি শক্তির সাথে সবদিক থেকে পাল্লা দেওয়ার সেই প্রভাব-প্রতিপত্তিও চিনের নেই।
তবে, চিন এই বার্তা আমেরিকা এবং তাদের মিত্রদের দিতে চাইছে যে তাদের ওপর খুব বেশি চাপ তৈরি করলে তারাও বসে থাকবে না। আর সে-চেষ্টা করলে আমেরিকা ভুল করবে।
তবে, অদূর ভবিষ্যতে দুই পরাশক্তির মধ্যে সামরিক সংঘাতের কথা কেউ এখনো বলছেন না। বেইজিংয়ে চায়না অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশনের ওয়াং হুইয়াও বলছেন, সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনা কম, কিন্তু মুক্ত বাণিজ্যের কারণে গত কয়েক দশকে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা অনেকটাই বন্ধ হয়ে যাবে। হয়তো দেখা যাবে, পুরো বিশ্ব ব্যবস্থা দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে, যার একদিকে চিন এবং অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র।
এই পরিস্থিতিতে উন্নয়নশীল বিশ্বের কিছু দেশ হয়তো চিনের দিকে ঝুঁকতে পারে। কারন, তিনি মনে করছেন, চিনের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের সাথে ৬০টিরও বেশি দেশ রয়েছে, যাদের সাথে এই কূটনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টা করতে পারে চিন।
সুতরাং এক্ষেত্রে আবার দুই মেরুতে ভাগ হয়ে যেতে পারে বিশ্বব্যবস্থা। এখন দেখার বাস্তব পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেয়।
সুতরাং এক্ষেত্রে আবার দুই মেরুতে ভাগ হয়ে যেতে পারে বিশ্বব্যবস্থা। এখন দেখার বাস্তব পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেয়।
মন্তব্যসমূহ