জামাই ষষ্ঠীতে একটি ব্যতিক্রমী কবি সম্মেলন
![]() |
জামাই ষষ্ঠীতে রিষড়ায় কবি সম্মেলন |
কানাইলাল জানা
গত রোববার ১লা জুন '২৫ রিষড়ায় ছিল পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘ রিষড়া আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক স্বপন পাঁজার আহ্বানে কবিসম্মেলন।
স্বপনবাবুকে যখন বলি জামাই ষষ্ঠীতে কেন এই সভা? যাওয়া সম্ভয় নয়। তাঁর উত্তর ছিল: 'তপন পাঁজা আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসবে',শুনে নড়েচড়ে বসি। আশ্চর্য চরিত্রের দুভাই স্বপন পাঁজা এবং তপন পাঁজা। উপকারাপাল পদে সবথেকে বেশিদিন ছ বছর চাকরি করেছি আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। একটি রাজনৈতিক হত্যাকান্ডে জড়িয়ে পড়ে তপন পাঁজা আছেন এখানে, আমার আসার আগে থেকে অর্থাৎ আটের দশক থেকে। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো আইনজীবীও চেষ্টা করে কিছু করতে পারেননি তাঁর জন্য। আশ্চর্য যে ছ'বছর ধরেই প্রতি সপ্তাহে দাদা স্বপন নিয়ম করে দেখা করতে আসতেন ভাইর সঙ্গে। ঝড় ঝঞ্ঝা কোনও পরিস্থিতিতেই এর অন্যথা হয়নি। জেলে তপন পাঁজার সঙ্গে তুলনা করতাম নকশাল বন্দি অরুণ হালদারের সঙ্গে। অরুণ হালদারের ব্যাপার স্যাপার সমসময় ছিল অদ্ভূত: একবার আমার এক বন্ধুকে নকশাল ওয়ার্ডে নিয়ে গেলে আগ বাড়িয়ে অরুণ হালদারের প্রতিক্রিয়া ছিল: 'আমরা তো চিড়িয়াখানার জীব, তাই বন্ধুকে দেখাতে নিয়ে এসেছেন।'
একদিন লকআপ হয়ে গেলে নিমতলায় বিশাল পর্দা টাঙানো হচ্ছে সিনেমা দেখানো হবে। কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে অরুণ হালদারের উত্তেজনা: 'নখ বাজা-ই, নখ বাজা-ই'। বলি, আপনি কি সত্যি নকশাল? তাঁর প্রশ্ন ধারাগুলো কি দ্যাখেন নি? বললাম দেখেছি, অস্ত্র চোখে দ্যাখেনি অথচ ২৫ (এ) ধারায় অস্ত্র আইনে বছরের পর বছর জেল খেটে গেছে এমন কাউকে কাউকে জানি। সেই কখন ঘন্টা পড়ে গেছে, আপনি তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যান।' আসলে সিনেমা দেখার অনুমতি নেই নকশালপন্থী বন্দিদের। ছাড়া পেলে অরুণকে একবার দেখি ময়দানের বইমেলার গেটে। মহাশ্বেতা দেবীর কাছে টিকিট দেখতে চাইলে গম্ভীর হয়ে তিনি বললেন: 'আমি কে জানেন?' নাম না জানিয়ে গটগট করে ভেতরে চলে গেলেন। সামনে দাঁড়িয়ে থেকে আমার মনে পড়ল বাল্যে দেখা 'রূপবান' যাত্রা পালার একটি দৃশ্য: সেনাপতিকে রাজ্যভার দিয়ে রাজা বাইরে গেলেন। বহুবছর পর ফিরে এলে রাজাকে চিনতে পারেননি সেনাপতি বলে খন্ডযুদ্ধ হয়। যুদ্ধে হেরে সেনাপতি ক্ষমা চাইলে রাজা বললেন ক্ষমা নয় তাঁর প্রাপ্য পুরস্কার। কারণ অপরিচিতকে চ্যালেঞ্জ করে ঠিক কাজই তো করেছেন সেনাপতি।
অরুণ হালদার টিকিট চেয়ে অন্যায় কিছু করননি। আসলে গিল্ডের উচিত ছিল প্রবীণ সাহিত্যকদের পাশ জাতীয় কিছু দেওয়া। যাইহোক তপন পাঁজা ছিলেন অরুণ হালদারের ঠিক বিপরীতে। তাঁর সব কিছুতে ছিল সুচারু ও সুন্দরভাবে থাকার অভ্যেস। সেন্ট্রাল জেলের বন্দিরা নানা ভাষাভাষীর। তাই দৈনিক পত্রিকাও আসে তেমনি নানা ভাষার। সকাল সকাল স্নান সেরে ধোপদুরস্ত পোষাকে গেটে এসে 'গণশক্তি' সংগ্রহ করা ছিল তপন পাঁজার কাছে একটি পবিত্র কাজ। প্রত্যেকটা লাইন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে আমাকে দিতেন একবার চোখ বুলিয়ে নিতে। কতবার শুনেছি সাধুকে বলছেন স্যরকে গোলাপচারা দাও।' আমি এড়িয়ে গেছি এই মনে করে যে, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত সাধু তার 'ওয়েজেস' থেকে টাকা তুলে নিষ্ঠাভরে গোলাপ বাগান করেছে জেলের ভেতরে। কাউকেই তার দেওয়া উচিত নয়। সান্ধ্য স্কুলে পড়ানো,ওয়ার্ড পরিষ্কার রাখা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন, পত্রিকা প্রকাশে সাহায্য করা সব ভাল কাজেই ছিলেন তপন পাঁজা। সব সময় খেয়াল রাখতেন আমাকে কথায় এবং কাজে কেউ ঠকাচ্ছে কি না। বলতাম 'ঠকালে ঠকব কিন্তু আমি তো কাউকে ঠকাচ্ছি না।'
বহু বছর পর যাবজ্জীবন সাজা খেটে লালগোলা মুক্ত কারা থেকে বাড়ি ফিরেছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে না গিয়ে পারলাম না।
তাঁদের সঙ্গে আমার অন্তত ৩৫ বছরের সম্পর্ক। রিষড়া কলেজে চাকরি করে বরাবর ভাইকে দেখেছেন অকৃতদার স্বপন পাঁজা। 'রিষড়া সমাচার' সম্পাদক কবিসম্মেলনও করেন গুছিয়ে। সব কবিই সবার কবিতা এবং আলোচনা শুনবেন। কলকাতার হলে যেমন হয়, তেমনটি একেবারেই চলে না। টিফিন এবং দুপুরে চমৎকার খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। সভাপতিকেও থাকতে হয় শেষ পর্যন্ত। কলকাতা এবং বিভিন্ন মহকুমা থেকে আসা কবিবন্ধুরা একে একে কবিতা পড়লেন। আমি পড়ি দুটি। একটি হুব্বা শ্যামলের প্রসঙ্গ অন্যটি ভাষা শহিদ কমলা ভট্টাচার্যকে স্মরণ। যেবার ভাষা শহিদের শহর শিলচরে যাই জুলাই মাস। ক্ষেপে ক্ষেপে বৃষ্টি পড়ছে। গায়ক কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য -র বাড়ির রাস্তাসহ প্রত্যেক গলির মুখে ভিজছে দশ শহিদের নামসহ ষোড়শী কমলার প্রতিকৃতি। বড্ড মায়াময় সে মুখ। এবার এমন করে মনে ভেসে এল যে তাঁকে মনে রেখে কতকগুলি কবিতা লিখে ফেলি। তার একটি দেখি দেবতোষ মাইতির পত্রিকা 'ঊনিশ কথা'-য়:
ভাষা দিবসে / কানাইলাল জানা
অনুষ্ঠান পরিচালনায়: সুব্রত সিংহ, আশিস চক্রবর্তী।
--------xx-------
তাঁদের সঙ্গে আমার অন্তত ৩৫ বছরের সম্পর্ক। রিষড়া কলেজে চাকরি করে বরাবর ভাইকে দেখেছেন অকৃতদার স্বপন পাঁজা। 'রিষড়া সমাচার' সম্পাদক কবিসম্মেলনও করেন গুছিয়ে। সব কবিই সবার কবিতা এবং আলোচনা শুনবেন। কলকাতার হলে যেমন হয়, তেমনটি একেবারেই চলে না। টিফিন এবং দুপুরে চমৎকার খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। সভাপতিকেও থাকতে হয় শেষ পর্যন্ত। কলকাতা এবং বিভিন্ন মহকুমা থেকে আসা কবিবন্ধুরা একে একে কবিতা পড়লেন। আমি পড়ি দুটি। একটি হুব্বা শ্যামলের প্রসঙ্গ অন্যটি ভাষা শহিদ কমলা ভট্টাচার্যকে স্মরণ। যেবার ভাষা শহিদের শহর শিলচরে যাই জুলাই মাস। ক্ষেপে ক্ষেপে বৃষ্টি পড়ছে। গায়ক কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য -র বাড়ির রাস্তাসহ প্রত্যেক গলির মুখে ভিজছে দশ শহিদের নামসহ ষোড়শী কমলার প্রতিকৃতি। বড্ড মায়াময় সে মুখ। এবার এমন করে মনে ভেসে এল যে তাঁকে মনে রেখে কতকগুলি কবিতা লিখে ফেলি। তার একটি দেখি দেবতোষ মাইতির পত্রিকা 'ঊনিশ কথা'-য়:
ভাষা দিবসে / কানাইলাল জানা
বোমা পুঁতে রাখার মতো মাটিতে পুঁতে রাখতে চাই স্বপ্নবীজ। গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখতে চাই গোছা করে মেঘ। গোঁজ করে ভাবনাগুলোকে রাখবো কাদামাটিতে। অঝোরে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টির ফাঁক দিয়ে পুনর্জন্ম নিয়ে ষোড়শী কমলা দেখবে কিভাবে এখনো কাঠ কয়লার মতো শোক লেগে আছে শিলচরের স্টেশন চত্বরে, শহরের আশেপাশে এবং সমগ্র বরাক উপত্যকার কোল ঘেঁষে। তাই দেখে পরিযায়ী পাখি হয়ে নেমে আসবে বাকি ভাষা শহিদরাও। বৃষ্টির ছন্দ সকলকে গাঁথবে মিলনক্ষুধার চিহ্নে...সভাপতি ড. স্বপন চট্টোপাধ্যায় কিছু সমালোচনা আনলেন। তার একটি 'সুইন হো স্ট্রিট'। কবি ও উপন্যাসিক তাপস রায়ের পত্রিকা। ড.স্বপন চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ সুইনহো কাজী নজরুল ইসলামকে শাস্তি দিয়েছিলেন। তাই তাঁর নামে পত্রিকা বা রাস্তা থাকবে কেন? আজকের কবিসভা আবার কাজী নজরুল ইসলাম এবং জীবনানন্দ দাশের ১২৬ তম জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে। একটি খবর দিই সুইনহো স্ট্রিটের নাম বদলে হয়েছে অনিল মৈত্র রোড। এবার পত্রিকার নাম বদলাবে কিনা সেটা তাপসের ক্ষেত্র।
রাত বাড়লে সকলে মিলে ছড়িয়ে দেবে মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না। জ্বলবে অক্ষর হয়ে। সেইসব জ্বলন্ত অক্ষর নিয়ে খুব ভোরে গড়ে তুলবে অসমবিলাসী মায়াতরু....
অনুষ্ঠান পরিচালনায়: সুব্রত সিংহ, আশিস চক্রবর্তী।
--------xx-------
মন্তব্যসমূহ