লন্ডন, ২০শে অক্টোবর— মতাদর্শের জন্য মানবসমাজের সন্ধান শেষ হয়ে গেছে এবং তথাকথিত পশ্চিমী উদারনৈতিক গণতন্ত্রই সর্বজনীন রূপ নিয়েছে, মানবসমাজের চূড়ান্ত রূপ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ১৯৯২-তে বলেছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা। তাঁর বই ‘এন্ড অব হিস্টরি অ্যান্ড দি লাস্ট ম্যান’ অবাধ বাজার এবং পশ্চিমী রাজনৈতিক ব্যবস্থার জয়গানের সবচেয়ে পরিচিত সওয়াল হিসাবে বিখ্যাত হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়, মার্কিন আধিপত্য ও একমেরুর বিশ্বব্যবস্থার তুঙ্গ মূহূর্তে ফুকুয়ামাই ছিলেন সেই বিশ্বব্যবস্থার দার্শনিক!
কেটে গেছে আড়াই দশক। এখন ফুকুয়ামা বলছেন, ‘সম্পদের পুনর্বণ্টনের জন্য সমাজতন্ত্রই পথ। আয় ও সম্পদের ক্ষেত্রে যে বিপুল অসাম্য তৈরি হয়েছে তা দূর করতে হলে সমাজতন্ত্রের মতাদর্শ পুনরায় ফিরেই আসতে পারে, বস্তুত তার ফিরে আসাই উচিত।’ লন্ডনের নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকাকে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারে ফুকুয়ামা বলেছেন, রেগান-থ্যাচারের আমল থেকে অবাধ বাজারের সুবিধা সম্পর্কে যে ধারণাসমূহ আধিপত্য করেছে তার ফলাফল বিপর্যয়কর হয়েছে।
যে ‘অবাধ বাজারের’ হয়ে তাঁর সওয়াল, তার রাজনৈতিক ফলাফল সম্পর্কে এর আগেও কিছু প্রশ্ন তুলেছিলেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক। কিন্তু এবারে তিনি আরও স্পষ্ট। সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সামাজিক সমতার ক্ষেত্রে শ্রমিক ইউনিয়ন দুর্বল হয়েছে, সাধারণ শ্রমিকদের দরকষাকষির ক্ষমতা দুর্বল হয়েছে। প্রায় সর্বত্রই মুষ্টিমেয় শ্রেণি তৈরি হয়েছে, তারা অন্যায় রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। আর্থিক সংকট থেকে আমাদের যদি কিছু শিক্ষণীয় থাকে তা হলো আর্থিক ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে, কেননা তারা সকলকেই মূল্য দিতে বাধ্য করে।
ফুকুয়ামা অবশ্য মনে করেন, উৎপাদনের উপকরণের সামাজিক মালিকানার ধারণা কাজ করবে না। কিন্তু সম্পদের ভয়ংকর অসাম্য অবসানে পুনর্বণ্টনের লক্ষ্যে সমাজতন্ত্র কার্যকরী হতে পারে। ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতন্ত্রের মতাদর্শ যে মাথা তুলছে, তার পিছনে এই কারণই নিহিত বলে তাঁর ধারণা।
পশ্চিমী দুনিয়ায় একদা সবচেয়ে পঠিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মানতে বাধ্য হয়েছেন, ‘এই সময়কালে মনে হচ্ছে কার্ল মার্কস যা বলেছিলেন তার কিছু কথা সত্যি বলে প্রমাণিত হচ্ছে। তিনি অতি উৎপাদনের কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন শ্রমিকরা দরিদ্রতর হবে, যথেষ্ট চাহিদার অভাব দেখা দেবে।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের যুদ্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না ফুকুয়ামা। সাক্ষাৎকারে তাঁর মন্তব্য, এক দেশ আরেক দেশকে সচেতনভাবে আক্রমণ করছে এমন না-ও হতে পারে। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করেছিল। কিন্তু স্থানীয় সংঘাত থেকে এমন যুদ্ধের সূচনা হতে পারে; তাইওয়ান, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ চীন সাগরের ঘটনাবলি থেকে।
একদা নয়া রক্ষণশীল শিবিরের তাত্ত্বিক বনে যাওয়া ফুকুয়ামা এখন মনে করেন ইরাকে যুদ্ধ, আর্থিক ক্ষেত্রে বিনিয়ন্ত্রণ, ভ্রান্তভাবে ইউরো তৈরি বড় ধরনের ভুল। এগুলি ছিল অভিজাতদের নির্দেশিত নীতি, যার ফলাফল হয়েছে বিপর্যয়কর। সাধারণ মানুষের হতাশ হবার কারণ রয়েছে।
‘এন্ড অব হিস্টরি’-র লেখক অবশ্য দাবি করছেন, ২৬ বছর আগের ওই বইয়েও তিনি উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ফাঁক দেখিয়েছিলেন। বিশেষ করে বলেছিলেন উদারনৈতিক গণতন্ত্র উন্নত জীবনের কী অর্থ তা তৈরিই করতে পারেনি। জীবনের লক্ষ্য তৈরি করতে পারেনি। ব্যক্তির ওপরে তা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্যহীন মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়েছে, অবশেষে পরিচিতিসত্তার ওপরে নির্ভর করছে যা কোনও এক ধরনের সমষ্টিবদ্ধতার অনুভূতি দিতে পারছে।
অতি দক্ষিণপন্থার উত্থান, পরিচিতিসত্তার ওপরে নির্ভর করে দুনিয়ার নিয়মকানুনের নয়া বিভাজনে উদ্বিগ্ন ফুকুয়ামা লিখেছেন তাঁর নতুন বই ‘আইডেন্টিটি: দি ডিমান্ড ফর ডিগনিটি অ্যান্ড পলিটিকস অব রিসেন্টমেন্ট’। বইয়ের নামেই স্পষ্ট অবাধ বাজার ও পশ্চিমী গণতন্ত্রের মডেল মানুষকে মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, জন্ম দিয়েছে এমন গভীর অসন্তোষের যা অতি দক্ষিণপন্থার রাজনীতিকে পুষ্ট করছে।
উৎস : গণশক্তি
মন্তব্যসমূহ